মূল্য
অঞ্জনা গোড়িয়া
বছর শেষে ঘুরে এলাম ডায়মন্ড হারবারের কেল্লা মাঠ। বেশ জমেছে মেলা। পিকনিক, হইচই, আনন্দ, মজা, ফুর্তি সব। নদীর পাড়ে সুন্দর এক পরিবেশ। আমিও ছিলাম এই আনন্দমেলায়। চড়ুইভাতি করতে পাড়ার ক্লাব থেকে।কিছু মধ্য বয়স্ক মহিলা এদিক ওদিক ঘুরে বেরাচ্ছে। কোমরে গামছা। মাথায় জট ভরা চুলের খোপা। সময় নেই ভালো করে চুল বাঁধার। শাড়িটি উঁচু করে পরা। চারিদিক তাকিয়ে আমাদের কাছে এলো। ভাবলাম কিছু খাবার চাইতে আসছে বুঝি। তখনও আমাদের খাওয়া হয়নি। ওদের দেখেই সাফ জানিয়ে দিল আমাদের একজন।এখানে খাবার টাবার হবে না। আমাদেরই খাওয়া হয় নি এখনো।
ওদের মধ্যে একজন বলল, না গো দিদি, আমরা খাবার আনতে আসিনি।
খাবার বানিয়ে দিতে এসেছি। বাসনপত্র মেজে সাফ করতে এসেছি। তোমাদের কিছু কাজ করব কি? সব্জি কাটা রান্না, বাসন মাজা সব।
আমি তো অবাক! পিকনিক স্পটে এমন কাজের লোকের পাওয়া যায়,জানা ছিল না।
কিন্তু আমরা যে নিজেরাই সব করব। কাজের লোক লাগবে না ।
ক্লাবের ছেলেরা বলে দিল এখানে কাজের লোক লাগবে না। ফিরে গেল হতাশ হয়ে।
একটা অল্প বয়সী বউ, মাথায় ঘোমটা টেনে গুটিগুটি পায়ে চলে গেল।পাশের আর দলের কাছে।
আমার খুব খারাপ লাগল। আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখলাম, কি করেন উনি?
বউটি ওই পিকনিক গ্রুপের কাছে গিয়ে বলল কাজের লোক লাগবে?
কিছু যুবক মদ্য পান করছে আর জোরে বক্স বাজিয়ে নাচা গানা করছে।কাঁচা মাংস রাখা আছে একটা পাত্রে। সবাই বোতল হাতে নেচেই চলছে।
মদ্যপ অবস্থায় যুবকরা হো হো করে হেসে উঠলো। রান্না করবে? বাহ, বেশ তো। দারুন জমবে আমাদের ফুর্তি। কত লাগবে বলো, আমাদের সেবা করতে?
বউটি বলল, আগে রাঁধি। কাজ করি। কাজ শেষে মূল্য দেবেন।
কথা শুনে মনে হলো বউটি বেশ শিক্ষিত। অভাবের তাড়নায় করতে হচ্ছে এমন কাজ।
বউটা লেগে পড়ল রান্নার কাজে।
প্লেট সাজানো চানাচুর। মদের বোতল ছড়ানো। পাশে রাখা হুঁকোর মতো একটা যন্ত্র। পাইপ দিয়ে শুষে টানছে নেশার সামগ্রী ।জোরে জোরে চলছে বক্সের উগ্র গান নাচ।সেই সঙ্গে মদের গন্ধে চারিদিকে বিষাক্ত হয়ে উঠছে। সেই পরিবেশে একা এক মহিলা ওদের খিদে মেটাচ্ছে।
একজন আঁচল টেনে ধরতে গেল। কেমন বিশ্রী ভাবে তাকিয়ে থাকল। আঁচলটা সাবধানে সরিয়ে নিল বউটি। মুখে কোনো কথা নেই। আরও একজন কিছু বলতে লাগলো। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে বউটিকে দেখে মনে হলো, খুব বিরক্তি বোধ করছে। তাড়াতাড়ি রান্না সেরে হাত পাতল পারিশ্রমিকের জন্য।
দিন, এবার কত দেবেন?
একজন বলল, আগে তো মনোরঞ্জন করো। যা চাইবে তাই পাবে। বলেই হাতটা ধরতে গেল।
বউটি স্বজোরে চড় মেরে বলল, আমরা গতর খাটিয়ে খাই। দেহ বেচে নয়। রান্না করতে ২০০ টাকা আর বাসন মাজতে ১৩০ টাকা লাগবে। এক পয়সাও বেশি নয়। এখন রান্নার দামটা দিন। খাওয়া হলে মেজে দেব সব। বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিল। ছেলেগুলো থতমত খেয়ে টাকাটা হাতে দিল। বউটি কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চলে গেল ঝুপড়ির আড়ালে।
যেখানে ঘুমিয়ে আছে কোলের শিশুটি। বউটি বুকে টেনে নিয়ে নিশ্চিন্তে স্তন পান করাতে লাগল।